অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী শাহনাজ সুমি। তার অভিনীত বিজ্ঞাপনের একটিমাত্র সংলাপ ‘আরও ছোট করে দিন, যাতে এভাবে আর ধরা না যায়’ সমাজের বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে গেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচিত হয়েছিল জুঁই নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনটি। আলাপ হয় মিষ্টি মেয়ে সুমির। আলাপকালে উঠে আসে সুমির জীবনের নানা ঘটনা অঘটনা, জীবনযাপন ও রূপালি পর্দায় তার বিচরণের নানা কথা।
কেমন আছেন?
শাহনাজ সুমি: ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো। নাটকে অভিনয় করেছেন, বিজ্ঞাপনেও। জানতে চাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে আছে কিনা?
শাহনাজ সুমি: হ্যাঁ, চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাই। কিছুদিন আগে একটি অমনিবাস ছবির শুটিং শেষ করেছি। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ১১টা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নিয়ে নির্মিত এ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিটির নাম ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’। এরই মধ্যে ছবিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিয়েছে। ছবিটিতে ফুটে উঠেছে ঢাকার মানুষের জীবনযাপন, সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার যুদ্ধ ও এ শহরের সংস্কৃতি।
মিডিয়াতে কাজের শুরু ও আলোচিত জুঁইয়ের বিজ্ঞাপনটি নিয়ে কিছু বলুন?
শাহনাজ সুমি: মিডিয়ায় আসা হয় চ্যানেল আইয়ের ‘সেরা নাচিয়ে’ প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে। যখন টপ টেনে ছিলাম তখন সালাউদ্দিন লাভলু ওনার একটি নাটকে নেন। গত বছর (২০১৭ সাল) ‘সোনার পাখি রুপার পাখি’ নামের ওই নাটকটি খুব হিট ছিল। নাটকটির বিজলি চরিত্রে অভিনয় করে অনেক প্রসংশিত হয়েছি। ওই নাটকে অভিনয় করার সময় জুঁই নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনের জন্য অডিশন দিই।

শাহনাজ সুমী। ছবি: সংগৃহীত
কোন নাচটির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছেন?
শাহনাজ সুমি: ‘সেরা নাচিয়ে’তে রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানের একটা নাচ করেছিলাম। গানটা যদিও স্বদেশ পর্যায়ের কিন্তু আমি নারীদের উদ্দেশ্যে ওই নাচের পরিবেশনটা করি। ওই নাচটা করে আমি সর্বোচ্চ স্কোর পেয়েছিলাম। গানটা ইউটিউবে ভাইরালও হয়। এবার চ্যানেল আইয়ের যে মিউজিক অ্যাওয়ার্ডটা হয়েছে, তার আগের বছর যে মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানটা হয়েছে সেখানে আমাকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ নাচটি আবার করতে বলা হয়। নাচটা আসলে তাদের ভালো লেগেছে বলেই আমাকে আবার করতে বলা হয়েছে। প্রথম এতো বড় একটা অনুষ্ঠানে আগের করা নাচটি করতে পেরে আমার বেশি ভালো লেগেছে।
নারীদের নিয়ে এ পর্যন্ত কয়টি কাজ করেছেন?
শাহনাজ সুমি: এ পর্যন্ত নারীদের নিয়ে দুইটি বিজ্ঞাপন করেছি। একটি হচ্ছে ‘জুঁই’ অপরটি বাসের মধ্যে মেয়েরা যে হ্যারাজমেন্ট হয় তা নিয়ে ব্রাকের একটি বিজ্ঞাপন। যতদিন পর্যন্ত নারীদের একটা ঠিকঠাক স্বাধীনতা ঠিক হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। কিন্তু আরেক দিক থেকে কাজ করার ইচ্ছা নেই। কারণ আমি চাই না নারীদের নিয়ে আর কাজ করতে হোক। তারা যেন শিগগিরই একটা ভালো পর্যায়ে যায়। নিঃসন্দেহে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীদের জন্য অনেক কাজ করছেন। তাই চাই নারীরা যেন খুব দ্রুত একটা প্রোপার জায়গায় যায়। আর আমাদেরও যেন নারীদের নিয়ে আর কোনো কাজ করতে না হয়।
কখনো কোনো লম্পটকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন?
শাহনাজ সুমি: হ্যাঁ, তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেদিন পরীক্ষা শেষ করে স্কুল থেকে মাত্র বের হলাম। ডান হাতে ছিল স্কেল আর বাঁ হাতে পরীক্ষার যাবতীয় জিনিসপত্র। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি লোক। সামনে আমারই স্কুলের ছোট ছোট দুইটা মেয়েও হেঁটে যাচ্ছিল। সম্ভবত ওরা ক্লাস ফাইভে পড়ে। লোকটিকে দেখলাম সামনে এগিয়ে গিয়ে ওদের একজনকে টাচ করে। ওরা অনেক ছোট ছিল তাই ওই লোককে কিছু বলতে পারে নাই। এরপর দেখলাম পাশের অপর মেয়েটাকেও টাচ করল ওই লোক। তার নোংরামি দেখে আমি খুবই বিরক্ত হই। কিছুক্ষণ পর দেখলাম সে একই ইনটেনশন নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমিও প্রিপারেশন নিলাম তাকে শিক্ষা দেওয়ার। ভাবলাম এই লোক আমার সাথে কিছু করুক আর না করুক কিন্তু সামনের দুইজনের সঙ্গে তো কিছু করেছে। যাই হোক লোকটি আমার কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে হাতের স্কেল দিয়ে দিলাম ইচ্ছামতো মাইর। স্কেলটাও কিছুটা ধারাল ছিল। এরপর তাকিয়ে দেখি লোকটার হাত কেটে রক্ত পড়ছে। এটাই আমার হাতে কারো মার খাওয়ার ঘটনা। এরপর আর এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হয়নি।
নাচসহ যাবতীয় অর্জনের পেছনে কার অনুপ্রেরণা সচেয়ে বেশি।
শাহনাজ সুমি: আমি আড়াই বছর থেকে নাচ করি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে নাচের স্কুলে ভর্তি হই। আমার নাচ ও যাবতীয় অর্জনের পেছনে আম্মুর অনুপ্রেরণা অনেক। আম্মু আমাকে শিখিয়েছেন, কীভাবে নাচকে ভালোবাসতে হয়। এরপর আমি একজন শিল্পীমনা মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি। খিলগাঁও-এর বাফা (বাংলাদেশ একাডেমী অব ফাইন আর্টস) থেকে নাচ শিখেছি। নাচ নিয়ে আসলে ভালো কিছু করতে চাই। যদিও এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দেখা যাক কী হয়।
মেয়ের অর্জন নিয়ে মা-বাবার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইব? সেই সঙ্গে মায়ের সেক্রিফাইস প্রসঙ্গ?
শাহনাজ সুমি: আম্মু অনেক সেক্রিফাইস করেন। আপুকে ও আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। ছোট বোনটাতো অনেক ছোট ওর খেয়াল রাখা। যখন কোনো নাচের রিহার্সেল থাকে, তখন সবাইকে খাইয়ে, আমাকে খাইয়ে তারপর আম্মু আমাকে নিয়ে রিহার্সেলে যায়। এদিকে আম্মুর নিজের খাওয়ার কোনো খবর নাই। আমি যখন প্রায় আড়াই মাস ‘সেরা নাচিয়ে’ প্রতিযোগিতার ক্যাম্পে ছিলাম তখন আম্মুর সাথে শুধু শুক্রবার দেখা হত। তখন দেখেছি, ওই একটা দিন আমাকে দেখে আম্মু কী পরিমাণ খুশি হত। আম্মুর সেক্রিফাইস শুধু আমার জন্য না, পুরো পরিবারের জন্য। আর বাবা, বাবা বলেই হয়তো অনুভূতিটা খুব বেশি প্রকাশ করে না। তবে বাবাও অনেক অনুপ্রেরণা দেয়। পড়াশোনা যাতে ক্ষতি না হয়, সে দিকে খেয়াল রেখেই কাজ করতে বলেন। বাবাও আমাকে নিয়ে গর্ব করে।

শাহনাজ সুমী। ছবি: সংগৃহীত
প্রথম নাটক ‘সোনার পাখি রুপার পাখি’ ও প্রথম বিজ্ঞাপন ‘জুঁই’। জীবনের প্রথম দুটি কাজই জনপ্রিয়তার তালিকায় উঠে আসে।
শাহনাজ সুমি: সব সময়েই ভালো কিছু করতে চেয়েছি। ‘সোনার পাখি রুপার পাখি’র আগে যে কোনো নাটকের অফার আসেনি তা নয়। জুঁই এর আগেও যে কোনো বিজ্ঞাপনের অফার আসেনি তাও কিন্তু নয়। আমার ইচ্ছা হচ্ছে, আমি দুই তিন বছর পরপর যদি একটা কাজ করি। ওই কাজটা যেন মানুষ ১০/১২ বছর বা ৫০ বছর মনে রাখেন। এ রকম কাজ করতে চাই আসলে। এটা ভাগ্যের একটা বিষয়।
এ সফলতার পেছনের রহস্য কী?
শাহনাজ সুমি: মানুষের ইচ্ছা থাকলে তা পূরণ হয়। তাই তখন নিজেকে কাজের উপযোগী করে তৈরি করছিলাম। মনোযোগ দিচ্ছিলাম নাচে ও অভিনয়ে সেই সঙ্গে টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে জোর দিচ্ছিলাম। এখনো নিজেকে তৈরি করছি। এ চেষ্টা থেকেই আসলে কাজগুলো আসে। যখন অভিনয় করি তখন দুই/তিন দিন ধরে অভিনয়ের ওই নির্দিষ্ট চরিত্রে বসবাস করি। শুটিং-এর দুই দিন আগ থেকেই গল্পের চরিত্রের ভেতর থাকা হয় আমার। যে চরিত্রে আমি বসবাসই করতে পারব না। ওই চরিত্রে অভিনয়ই বা করব কীভাবে। এ পর্যন্ত যে কাজগুলো করেছি, আলহামদুলিল্লাহ, এতে আমি সন্তুষ্ট।
এই যে এতো কাজ করছেন, এখানে আপনের মূল প্রাপ্তিটা কী?
শাহনাজ সুমি: নিজে থেকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি, ‘আমার সম্মানী কতো?’ আমাকে সম্মান দর্শকরা দেবেন। একটা সময় দর্শকদের ভালোবাসার জন্য কাজ করতাম। ওই যে বলে না সম্মানী বা পেমেন্ট, আমার পেমেন্টা ছিল দর্শকদের ভালোবাসা। কিন্তু যখন দেখলাম কিছু পরিমাণ দর্শক ছড়িয়ে পড়া অপপ্রচার নিয়ে মেতে আছেন। তখন সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাই। অনেক কষ্ট করে একটি বিজ্ঞাপন করলাম। ধরুন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কষ্ট করে ওই বিজ্ঞাপনের কাজটা করলাম। প্রচারের পর ভালো জিনিসগুলো মানুষ দেখছেন, বাহবা দিচ্ছেন। ঠিক দুইদিন পর আবার ভুলে গেছেন। ভারতের আসামের পায়েল নামের একজন নার্সের আপত্তিকর ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। কেউ একজন ওই ভিডিওর ক্যাপশনে আমার নাম লিখে অপপ্রচার ছড়ায়। তখন দেখেছি, মানুষ আসলে ভালোর চেয়ে খারাপের প্রতি বেশি মনযোগী। এতে আমি এতটাই কষ্ট পেয়েছি যে, বলে বুঝাতে পারব না। তখন মনে হয়েছে,কাদের জন্য কাজ করছি?
কিছু পরিমাণ দর্শকতো আবার ভীষণ রকমের ভালোও বাসেন।
শাহনাজ সুমি: হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসেন এমন ভক্তও আছে। তাদের প্রতি আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। হয়তো ওনাদের জন্যই এখনো কাজ করছি। এখানে এসে কথা বলাটাও হয়তো ওনাদের জন্যই। এই মানুষরাই যখন বলেন, ‘লাভ ইউ বিজলি’, ‘ক্রাশ বিজলি’। তখন আমার ভালোলাগে। কিন্তু যখন কোনো মিথ্যা বিষয় নিয়ে তারা মেতে থাকেন, তখন আমার খুবই কষ্ট হয়।
সামনের দিনগুলোকে কীভাবে সাজাতে চান?
শাহনাজ সুমি: এবার এইচএসসি পরিক্ষা দেবো। এই মুহূর্তে পরীক্ষাটা আমার কাছে প্রধান বিষয়। এইচএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবো। যে সাবজেক্টই পাব তাতেই ভর্তি হয়ে যাব। আর মিডিয়া আমার শখের জায়গাতেই থাকবে। একে আমি পেশা হিসেবে নেব না।
স্কুল, কলেজ ও সহপাঠীদের কাছে আলাদা কদর নিশ্চয়ই পান? তাদের অনুপ্রেরণা সহযোগিতা সম্পর্কে কিছু বলুন?
শাহনাজ সুমি: আমার স্কুল কলেজের টিচার ও সহপাঠীদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। ওনারা ছাড় না দিলে হয়তো এতোদূর আসতে পারতাম না। প্রতিদিন রিহার্সেলের কারণে ক্লাসে বেশি এটেন্ড করতে পারতাম না। বছর শেষে দেখা গেছে আমার মাত্র ৫ শতাংশ উপস্থিতি। টিচাররা আগে থেকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতেন। তাদের বিশ্বাসের মর্জাদা আমিও রাখতাম। তাই যখন ভালো ফলাফল করতাম তখন আর আমাকে কিছু বলা হতো না। মিডিয়াতে আসার আগে থেকেই বন্ধুরা আমাকে অনুপ্রেরণা দিত, এখনো সেই অনুপ্রেরণাই দিচ্ছে। ওরা চায় ওদের ফ্রেন্ডটা আরও উপরে যাক।
পছন্দের নৃত্যশিল্পী কে?
শাহনাজ সুমি: মাধুরী দীক্ষিত। ওনার হাসি দেখলেই মনে হয় যেন আর কোনো গহনার দরকার নাই। তার ‘ল্যায়লা মজনু’ গানের নাচটা বেশি পছন্দ। আর বাংলাদেশের অনেকেই আছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন অপি করিম আপু, বিজরী বরকতউল্লাহ আপা, রুমানা রশীদ ঈশিতা আপু, শমী কায়সার।
পছন্দের তিন জন অভিনেতার সম্পর্কে জানতে চাই।
শাহনাজ সুমি: মোশাররফ করিম, ওনার কাছে অনেক কিছু সেখার আছে। আরিফিন শুভকে ভালোলাগে। নিশো ভাইকে যেকোনো চরিত্রে ভালো লাগে।